সাব্বির মির্জা স্টাফ রিপোর্টার

কনকনে শীতের রাতে একটা গরম কাপড়ের অভাবে রেলস্টেশনের কিশোর মহররম বা বস্তির বৃদ্ধ তমজুদ্দীন যখন ঠকঠক করে কাঁপতে থাকেন, তখন তাদের অশ্রুই কি রাতের শিশির হয়ে ঝরে পড়ে? যাদের বদৌলতে এই দুস্থ মানুষের কাছে এখন শস্তা ঝুটের কম্বল পৌঁছে যাচ্ছে, সেই কম্বলের গ্রাম নিয়ে কথা বলব আজ। কম্বলের গ্রামগুলোতে এখন রাত-দিন বিরামহীন খেটে চলেছেন কম্বল তৈরির কারিগররা।

যমুনা নদীভাঙনকবলিত সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার শিমুলদাইড়, বরশীভাঙ্গা, সাতকয়া, শ্যামপুর, ছালাভরা, কুনকুনিয়া, পাইকরতলীসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামে তৈরি হচ্ছে বাহারি ঝুটের কম্বল। আর এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত এসব এলাকার প্রায় ২৫ হাজার মানুষ।

গত ২৩ বছর ধরে এ এলাকায় ঝুট কাপড়ের কম্বল তৈরি হচ্ছে। কম্বলগুলো দামে শস্তা হওয়ায় স্থানীয় প্রবাদই রয়েছে, ‘গরিবের সম্বল কাজীপুরের কম্বল।’ আর কম্বল সেলাই করেই এখানকার অনেক নারী, পুরুষ স্বাবলম্বী হয়েছেন।

দুই যুগ আগের কথা। যমুনা শিকস্তি কাজীপুরের মানুষ ভাঙা-গড়ার নিরন্তর সংগ্রামে রত। এরই মধ্যে বর্ষা-বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর চাষযোগ্য জমি হারানোর ফলে শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত বেকার মানুষের জীবন চালানো খুবই মুশকিল। বিকল্প উপার্জনের পথ বাছতেই এক দিন বড়শীভাঙ্গার সাইদুল হক চলে যান ঢাকার মিরপুরে। তারপর ঝুট কাপড় কিনে এনে তা সেলাই করে তৈরি করেন কম্বল। সাইকেলের পেছনে তুলে বিক্রি শুরু হয় গ্রামে গ্রামে। হাতে আসে অনেক টাকা। বদলাতে থাকে সাইদুলের জীবন। সাইদুলের দেখাদেখি হাজি জিয়া, চাঁন মিয়া, মনির হোসেনরাও শুরু করেন এই ব্যবসা। তারপর থেকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি এ তল্লাটের মানুষকে।

গার্মেন্টসের ফেলে দেয়া ঝুট কাপড় বিশেষ কায়দায় সেলাই করে তৈরি করা হয় এই ঝুট কম্বল। এলাকার কিশোরী থেকে শুরু করে বয়োঃবৃদ্ধ নারীরা এখন প্রশিক্ষণ নিয়ে ঝুটের কম্বল সেলাই করছেন।

কম্বলের কারিগর সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘মহাজনের কাছ থেকে প্রথমে পাঁচ হাজার টাকা ধার নিয়ে ঢাকায় গিয়ে ঝুট এনে কম্বল তৈরি করে বিক্রির শুরু করি। বাড়ির বউ, মেয়ে, মা সবাই এ কম্বল সেলাই করতে থাকে। আমার পরিবারের দেখাদেখি পাশের বাড়ির মহিলারাও সেলাই শুরু করেন। শুরু হয় সেলাই বিপ্লব। আর এই বিপ্লবের ৮০ ভাগ কারিগর হলেন নারী।’

এ অবস্থা দেখে এবার উপজেলা গভর্ন্যান্স প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বেশ কজন দুস্থ-অসহায় নারীকে। তারা এ প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন অনেকের মতো ঝুট কম্বল সেলাই করে নিজেদের সংসারে অভাব নামক দানবটাকে তাড়াচ্ছেন।

কথা হয়, শিমুলদাইড় গ্রামের সত্তর ছুঁইছুঁই অমিছা খাতুনের সঙ্গে। এই বয়সেও পেটের তাগিদে খেটে চলেছেন। বললেন, ‘ঘরে বইসা বইসা কাম করি। বেশি কষ্ট অয় না। দুইটা পয়সা ঘরে এলে ভালা লাগে।’

কম্বল ব্যবসায়ী সোহেল রানা বলেন, ‘বর্তমানে একটি চার হাত দৈর্ঘ্য ও পাঁচ হাত প্রস্থের লেপ বানাতে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা লাগে। অথচ সেখানে একই সাইজের একটি ঝুট কম্বল ১০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। ব্লেজার তৈরির পরিত্যক্ত ঝুট জোড়া দিয়ে বানানো ঝুট কম্বল একদিকে যেমন হালকা, অন্যদিকে প্রচণ্ড শীতেও এই কম্বল বেশ গরম ও আরামদায়ক। ৪ কেজি ঝুট কাপড়েই একটি কম্বল বানানো চলে। গত বছর এই ঝুটপ্রতি কেজি ১০-১২ টাকায় কেনা যেত। কিন্তু বর্তমানে ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে কিনতে হচ্ছে। গরমের সময় প্রতি কম্বলের মজুরি ২০ টাকা এবং শীতের সময় ৪০ টাকা। নারী শ্রমিকরা তাদের গৃহস্থালি কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসব কম্বল সেলাই করেন।’

ছালাভরা গ্রামের নারী শ্রমিক আমিনা বেগম জানান, প্রতিদিন কম্বল সেলাইয়ের কাজ করে গড়ে ১০০ থেকে ১৭০ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। আর এই আয় দিয়ে চলে তার সংসার। দুটি সেলাই মেশিনে তারা মা-মেয়ে কম্বলের কাজ করে অনেটাই স্বাবলম্বী হয়েছেন।

ঝুট ব্যবসায়ী সংগঠনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ঝুট কম্বলের জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে এর চাহিদা এখন বলতে গেলে সারা দেশব্যাপী।’

সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সহসভাপতি মো. এমদাদুল হক এমদাদ বলেন, ‘সম্ভাবনাময় এ শিল্পকে কেন্দ্র করে কাজীপুরে গড়ে উঠেছে কম্বলের বাজার। দামে কম আর উন্নতমানের হওয়ায় প্রতিদিনই পাবনা, রাজশাহী, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা আসছেন কম্বল কিনতে। প্রতিদিন প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকারও বেশি কম্বল কেনাবেচা হয় এই বাজারে। সরকার ও দেশের বিত্তবানরা ত্রাণের জন্য দেশের বাইরে থেকে কম্বল আমদানি না করে এখান থেকে কিনলে আমাদের এই শিল্পটির আরো প্রসার হবে।’

স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রকৌশলী তানভীর শাকিল জয়  বলেন, ‘আমি উপজেলা গভর্ন্যান্স প্রজেক্টের সহায়তায় এই শিল্পের প্রসারের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। এরা যাতে অতি সহজে ঝুট কিনতে পারে সেজন্য স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপ, মণ্ডল গ্রুপ, ফকির গ্রুপসহ বিভিন্ন গার্মেন্টসের সঙ্গে এদের যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আশা করি, একসময় এ শিল্প দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don`t copy text!