নিজস্ব প্রতিবেদক :

বগুড়ার শিবগন্জ উপজেলার মাঝিহট্ট ইউনিয়নের দামগাড়া সৈয়দ মিনা উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ, স্থানীয় সংসদ সদস্যের ডিও লেটার এবং স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পাঠানো সুপারিশকে পাশ কাটিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পার না করা এক ব্যক্তিকে পরিচালনা কমিটির সভাপতি করা হয়েছে।

বর্তমানে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি হতে হলে শিক্ষাগত যোগ্যতা কমপক্ষে স্নাতক ডিগ্রি হতে হয়। এখন বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সভাপতি হওয়ার জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চমাধ্যমিক করা হলেও বগুড়ার শিবগন্জ উপজেলার মাঝিহট্ট ইউনিয়নে দামগাড়া সৈয়দ মিনা উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি করা হয়েছে মোঃ  আবদুল গফুর মন্ডল নামের ‘ক্লাস ফোর’ পাস করা এক বিতর্কিত ব্যক্তিকে । তার বিরুদ্ধে চুরি (৪২৭ ধারা) নারী নির্যাতনের মামলা, একাধিক বিবাহের কারণে জেলে যাবার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

গত ২৮ শে ফেব্রুয়ারী আব্দুল বাসিত মন্ডলকে সৈয়দ মিনা উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে নিয়োগ দেয় রাজশাহী মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড।বিতর্কিত ব্যক্তি গফুর মন্ডলকে সভাপতি করার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন স্থানীয় অভিভাবকরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্কুলটির প্রধান শিক্ষক তোহিদুর  রহমান নিয়ম অনুযায়ী  তিনজনের সুপারিশকৃত তালিকা পাঠান শিক্ষাবোর্ডে। তালিকার পছন্দক্রমের শীর্ষে স্কুলটির দাতা সদস্য  এহসানুল হক সাহানা নামের এক ব্যবসায়ীর নাম ছিলো। তিনি বিএ পাশ,  স্কুল প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা ছিলো। কিন্তু শিক্ষাবোর্ড থেকে ক্লাস ফোর পাস আবদুল গফুর মন্ডলকে সভাপতি হিসেবে চুড়ান্ত করে চিঠি দেয়া হয় স্কুলটির প্রধান শিক্ষককে।সৈয়দ মিনা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দেয়া তালিকার বাইরে একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে পরিচালনা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত করার কারণে সংক্ষুব্ধ স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা, দাতা সদস্যরাও।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বগুড়ার শিবগন্জের মৃত মনির উদ্দিনের ছেলে মোঃ আঃ গফুর মন্ডল (৪৮) শিবগঞ্জ থানায় পেনাল কোডের ধারায় মামলা রয়েছে। তবে এই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি গফুর মন্ডলকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া ১৪৩ ধারায় (ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত) মামলা রয়েছে। ৩৮০ ধারা গবাদি পশুর সংক্রান্ত আরেকটি মামলার সন্ধান মিলেছে তার বিরুদ্ধে। ৪২৭ ধারায় (চুরি) দায়ের করা  শিবগঞ্জ থানার অন্য একটি মামলার আসামি গফুর মন্ডল।

স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিবেদককে বলে, গফুর মন্ডল প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পার করেন নি৷ ক্লাস ফোর থেকে পড়াশোনা ছেড়ে ছাগল চুরি শুরু করেন। শিবগন্জ এলাকায় ছাগল চোর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরে ছাগলের ব্যবসা করে টাকা পয়সা কামিয়েছেন। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়েছিলো। তার মতো লোককে স্কুলের সভাপতি করার মতো লজ্জাজনক কিছু হতে পারে না।

স্থানীয় একাধিক সুত্রে জানায়, ব্যক্তিজীবনে ছাগল চোর হিসেবে কুখ্যাতি আছে তার। এছাড়া একাধিক নারীকে বিয়ে করে এলাকায় হাস্যরসের জন্ম দিয়েছেন তিনি৷ নারী নির্যাতনের মামলায় জেলও কেটেছেন।

এদিকে নিয়োগ পেয়েই স্কুলটির প্রধান শিক্ষক তোহিদুর রহমানের সাথে দুর্ব্যবহার শুরু করে দিয়েছেন নতুন সভাপতি গফুরন্ডল। প্রতিবেদকের হাতে আসা একটি অডিও রেকর্ডে গফুর মন্ডলের দুর্ব্যবহারের প্রমাণ মেলে। তাকে বলতে শুনা যায় এই মিয়া, আমি স্কুলের সভাপতি মিয়া। কথা ভালো করে বলবেন।ছুটিতে থাকার কারণে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি সভা ডাকতে পারবেন না বলার কারণে প্রধান শিক্ষককে গালমন্দ করেন গফুর মন্ডল।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনৈতিক ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে বিভিন্ন অভিযোগ পাশ কাটিয়ে  সৈয়দ মিনা উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি হয়েছেন মোঃ গফুর মন্ডল। অভিযোগের তীর রাজশাহী মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের সচিব হুমায়ুন কবিরের দিকে। সুত্রমতে গফুর মন্ডলকে সভাপতি করতে প্রভাব বিস্তার করেছেন শিক্ষাবোর্ডের সচিব।

এবিষয়ে জানতে, শিক্ষাবোর্ডের সচিব হুমায়ুন কবিরের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেন নি। মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি জবাব দেন নি মেসেজের।

স্কুল থেকে পাঠানো  নামের বিপরীতে আঃ গফুর মন্ডলকে সভাপতি হিসাবে মনোনীত করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড রাজশাহীর স্কুল পরিদর্শক মোঃ জিয়াউল হক  বলেন, মনোনীত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি কোন অভিযোগ থাকে বা কেউ অভিযোগ করে তাহলে আমরা সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবো।

গত ২৮ তারিখে চেয়ারম্যান বরাবর স্কুলের দাতা সদস্যের প্রেরিত অভিযোগের বিষয় তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমার জানা নেই।আমি কাগজ হাতে পেলে চেয়ারম্যান স্যারের নির্দেশ অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

জানা যায়, বিদ্যালয় বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৬০ জন এবং ১৫ জন শিক্ষক ২ জন কর্মচারী রয়েছেন। বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হবার পর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদকে গত ১৩ অক্টোবর বরখাস্ত করেন ম্যানেজিং কমিটি।সহকারি শিক্ষক তৌহিদুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিদ্যালয়টির পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতির সহযোগিতায় , শিক্ষক, কর্মচারী স্বাক্ষরিত বিল ফর্ম আটকে রেখে সমালোচনার জন্ম দেন বরখাস্তকৃত ওই প্রধান শিক্ষক। গেল বছরের  সেপ্টেম্বর মাসের বেতন ভাতা উত্তোলন করতে না পারায় শিক্ষক কর্মচারীরা  উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট আবেদন করেন৷ এর আগে স্কুলটির পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতির দূর্নীতিও প্রমাণিত হয়েছে।

অভিযোগ বরখাস্তকৃত প্রধান শিক্ষক ও সাবেক সভাপতির সিন্ডিকেট  বহাল রাখতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের তালিকা এড়িয়ে  গফুর মন্ডলকে নতুন সভাপতি করা হয়েছে। সুত্রমতে, স্কুলের পুকুর নিয়ে নজিরবিহীন  দূর্নীতি ধামাচাপা দিতে এগারো লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে বিতর্কিত ব্যক্তি গফুরকে চেয়ারে বসানো হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  এক শিক্ষক জানান, উপজেলার মাঝিহট্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এসকেন্দার আলী সাহানা গত বছরের  ১৬ আগস্ট দামগাড়া সৈয়দ মিনা উচ্চ বিদ্যালয়ের এক মিটিংয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে একজনের উপর চড়াও হন। উত্তেজিত কণ্ঠে জানতে চান, কেন তার বক্তব্যে চেয়ারম্যানকে সম্বোধন করেনি, কেন তাকে ফুল দিয়ে বরণ করেনি। আর সেজন্য উত্তেজিত হয়ে তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে দেখা যায় । নতুন করে এই ধরনের ছাগলের কারবারি ( গফুর মন্ডল)  যদি স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি হন তাহলে ওই স্কুলের কোন শিক্ষক বা প্রধান শিক্ষককে গালমন্দ করাটাই স্বাভাবিক।

প্রসঙ্গত, শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারিত না থাকায় যে কেউ স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতির পদে বসে শিক্ষকদের ওপর খবরদারি করতেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নীতিমালার কারণে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এখনো স্বজনপ্রীতি ও দূর্নীতি মধ্য দিয়েই পরিচালনা কমিটির সভাপতি পদে বসানো হচ্ছে বিতর্কিত ব্যক্তিদের।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা, আর্থিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা তদারকিকরণ, লেখাপড়ার মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ধারণা থেকে স্কুলের ক্ষেত্রে ‘ম্যানেজিং কমিটি’ ও কলেজের ক্ষেত্রে ‘গভর্নিং বডি’ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। অথচ বেশির ভাগ কমিটি স্কুল-কলেজকে নিজের অর্থ আয়ের অন্যতম উৎস হিসেবেই দেখছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ডুবছে এই কমিটির বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণেই।

অদক্ষ ও অযোগ্য ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেয়ার কারণে অধিকাংশ কমিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার মান উন্নয়নে কোনো ভূমিকা না রেখে প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের বোঝা বাড়িয়েছে। নিয়োগ ও ভর্তিবাণিজ্য থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানের ফান্ড থেকে টাকা খরচ করা ছাড়া খুব একটা দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় না। যে দায়িত্ব পালনে শিক্ষার মান ও পরিবেশ স্বাভাবিক থাকে, সে দায়িত্বগুলোর প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ থাকে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don`t copy text!