সাব্বির মির্জা স্টাফ রিপোর্টার

মেরিনা খাতুন। এক সংগ্রামী যুদ্ধশিশুর নাম। জীবনের ক্যানভাস জুড়ে যেন তার দুঃখ আর বঞ্চনার গল্প। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি।

একাই সংগ্রাম করে গেছেন স্বাধীনতার ৫০ বছর। সামাজিক অপবাদ আর জন্মের গ্লানি তাকে প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খেয়েছে। এত কিছুর পরও রাষ্ট্রের কাছে তার একটাই দাবি ছিল, যুদ্ধশিশুর স্বীকৃতির। অবশেষে সরকার তার আবেদনের প্রেক্ষিতে সকল যুদ্ধশিশুকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে চলেছে। মেরিনা খাতুন সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার সদরের ওয়াপদা বাঁধ এলাকার মো. ওমর আলীর স্ত্রী।

গত ৮ সেপ্টেম্বর যুদ্ধশিশু হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চেয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে তিনি একটি আবেদন পাঠান। এর আগে ২০১৮ সালের ৪ জুলাই তার মা পচি বেওয়াকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক রাষ্ট্রীয়ভাবে বীরাঙ্গনা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

মেরিনা খাতুনের আবেদন থেকে জানা যায়, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমার মা পচি বেগম পাকবাহিনী ও তার দোসরদের দ্বারা পাশবিক নির্য়াতনের শিকার হন। সে সময়ই আমি জন্মগ্রহণ করি। আমার মা তখন বিধবা। লোকলজ্জার ভয়ে তিনি আমাকে ভ্রূণেই শেষ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যগুণে আমি বেঁচে যাই।

সম্প্রতি আমার মা পচি বেগম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেও আজও আমি আমার পরিচয় নিশ্চিত করতে পারিনি। আমাকে নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্যান্য টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার। মক্তিযুদ্ধ চলাকালে নানা কাজে যুক্ত মানুষদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিচ্ছে। তাই আমিও যুদ্ধশিশু হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রার্থনা করছি। যাতে অন্তত আমার সন্তানরা সমাজে তাদের মায়ের ইতিহাস নিয়ে বিব্রত না হয়। 

মেরিনা খাতুনের আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে নির্যাতিতা বীরঙ্গনার সন্তানদের ‘যুদ্ধশিশু’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

গত সোমবার (২৪ অক্টোবর) জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৮২তম বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসংক্রান্ত প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে পাঠানো হবে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।

মেরিনা খাতুন বলেন, তার মা বীরঙ্গনা পচি বেগম যুদ্ধশিশুকে পেটে ধরে সমাজের বহু মানুষের বিদ্রুপ সহ্য করেছেন। তিনি নির্মম সত্য প্রকাশ করে বলেন, ‘সমাজের কিছু মানুষের দেওয়া যন্ত্রণায় আমি যখন ভূমিষ্ঠ হইনি তখন মানুষের বিষমাখা কথায় আমার মা অপমানে অসহ্য হয়ে কীটনাশক পান করে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মারা যাননি। ’

তাড়াশের যুদ্ধশিশু মেরিনার জীবন-জীবিকা নিয়ে যুদ্ধ করতে হয় প্রতিনিয়ত। তার ১০ সদস্যের অভাব-অনটনের সংসার। বেকার স্বামী। ছেলেদের চা বিক্রির টাকায় কোনোমতে চলে সংসার।

মেরিনা আরো জানান, ১৯৮৪ সালে তার ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয় তাড়াশের ওমর আলীর সাথে। ওমর আলী জানান, যুদ্ধশিশু মেরিনাকে বিয়ে করার জন্য তাকেও লোকজন নানা কটুকথায় বিরক্ত করত।

তাড়াশের উত্তর ওয়াপদা বাঁধ পাড়ায় বর্তমানে ৫ শতাংশ জায়গার ওপর নির্মিত টিনশেড ঘরে স্বামী-সংসার নিয়ে বসবাস করেন যুদ্ধশিশু মেরিনা। তার তিন ছেলে মিজানুর রহমান মিলন (৩০), মামুনুর রশিদ (১৯), মতিউর রহমান (১৬), মেয়ে উম্মে হানী (২৫)। এর মধ্যে ছেলে মিলন, মামুনুর রশিদ ও মেয়ে উম্মে হানীকে বিয়ে দিয়েছেন। অভাব-অনটনের কারণে সংসারে যুদ্ধশিশু মেরিনার প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয় সাংসারিক নানা কাজে। তিনি জানান, বর্তমানে বয়স হওয়ায় তিনি  নানা রোগে আক্রান্ত। অনেক সময় ওষুধ কেনার মতো টাকা থাকে না।

মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আরশেদুল ইসলাম বলেন, ‘মেরিনা খাতুনের সকল কাগজপত্র সম্পন্ন করে আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের যুদ্ধশিশুদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত আমাদের গর্বিত করেছে। ’

যুদ্ধশিশু মেরিনা খাতুন বলেন, ‘আমি যুদ্ধশিশু হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চেয়েছি। এ অধিকার রাষ্ট্র যেন আমাদের দেয়। আমার মতো যত যুদ্ধশিশু আছে তারা যেন তাদের পরিচয় নিয়ে বিব্রত না হতে হয়। ’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don`t copy text!