মোঃ নাজমুল হুদা, লামাঃ

মরহুম আবদুল মালেক চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত জীবন জনাব চৌধুরী আনুমানিক ১৯৪৪ সালে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার কাকারা ইউনিয়নের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন।

তার পিতা প্রখ্যাত আলেম ও ইসলামিক ব্যক্তিত্ব মরহুম মৌলভী আবুল ফজল, মাতা মরহুমা রৌশন আরা চৌধুরী এবং স্ত্রী মরহুমা আয়েশা বেগম।
তার দাদা মরহুম মৌলভী আবদুর রহমান ছিলেন প্রখ্যাত পীরে কামেল।
একমাত্র জেঠা মৌলভী ইদ্রিছ আহমদ তিনিও প্রখ্যাত পীরে কামেল। মাতা রৌশন আরা চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন চকরিয়ার কাকারার সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে। নানা মরহুম জাকের আহম্মদ চৌধুরী,বোর্ড প্রেসিডেন্ট মরহুম মোস্তাক আহম্মদ চৌধুরীর ভাই।

চকরিয়া কক্সবাজারের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব,
বৃহত্তর কাকারার দীর্ঘ দিনের চেয়ারম্যান মরহুম আলহাজ্ব আনোয়ার হোসেন চৌধুরী তার জেঠাত ভাই।

তিনি চকরিয়া (সরকারী) উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস এস সি, চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ থেকে এইচ এস সি, পাকিস্তানের করাচি থেকে প্রথম শ্রেনীতে প্রকৌশল ডিগ্রী ও স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন।

কর্ম জীবনের শুরুতে জনাব চৌধুরী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান শিপিং কর্পোরেশনে স্বল্প সময় চাকুরী করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এক সেনা কর্মকর্তা বন্ধুর অনুরোধে সেনাবাহিনীর ইন্জিনিয়ার্সের সাপ্লায়ার ও ঠিকাদার হিসেবে অনগ্রসর পাহাড়ি জনপদ লামায় গমন করেন।

খুব অল্প সময়ের মধ্যে তৎকালীন পার্বত্য রাঙামাটি জেলার স্বনামধন্য প্রথম শ্রেনীর ঠিকাদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। একই সময়ে ঠিকাদারির পাশাপাশি বহুমুখী ব্যবসায়ী হিসেবে তার সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

তিনিই সর্ব প্রথম লামায় ব্রিক ফিল্ড ব্যবসার সূচনা করেন। লামা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রথম দ্বীতল ভবন, লামা টাউন হল, বর্তমান লামা আদালত ও সদ্য ভেঙ্গে ফেলা উপজেলা পরিষদ ভবন, পুরাতন লামা আনসার ক্যাম্প, তৎকালীন আলীকদম সেনানিবাসের বিভিন্ন বিল্ডিং তার ঠিকাদারী কর্মের উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে।এছাড়াও তিনি পার্বত্য জেলার বিভিন্ন জায়গায় ঠিকাদারী প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন।

ব্যবসা বানিজ্যের পাশাপাশি জনাব চৌধুরী লামা ও তৎসংলগ্ন এলাকার দরিদ্র, অসহায় ও নিপিড়ীত মানুষদের অকাতরে দান ও সহযোগিতা করার মধ্য দিয়ে তাদের অত্যন্ত আপনজন ও আস্থার প্রতীকে পরিনত হন, হয়ে উঠেন অসাধারণ জনপ্রিয় এক ব্যক্তিত্ব।

আশির দশকের শেষ ও নব্বই দশকের শুরুতে লামা আদালতে বিচারক সংকটের কারনে, আদালতের নিয়মিত বিচারিক কার্যক্রম নিশ্চিত করার জন্য তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক জুলফিকার আলী মহোদয়ের সুপারিশে সরকার জনাব আবদুল মালেক চৌধুরীকে অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি প্রায় দুই বছরের অধিককাল সফলতার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে সরকার বাহাদুর তাকে সরকারি চাকুরিতে নিয়মিত হবার সুযোগ প্রদান করলেও তিনি তা গ্রহন করননি। কারন ইতিমধ্যেই তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন এতদঞ্চলের শীর্ষ ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে। চাকুরী জনাব চৌধুরীকে কখনো আকর্ষন করতে পারেনি, এটা তার মজ্জায় ছিলনা যে কারনে হয়েছিলেন পিতার বিরাগভাজন।

এরশাদ সরকারের আমলে উপজেলা ঘোষিত হলে লামার ধর্ম, বর্ন ও জাতি নির্বিশেষ আপামর জনসাধারণ তাকে লামা উপজেলার প্রথম নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী করেন। কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাত্র কয়দিন আগে সরকার নির্বাচন স্থগিত করে নয়তো তিনিই হতেন লামার প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান। পরবর্তীতে পুনরায় তফসিল ঘোষিত হলে পিতার অনাগ্রহের কারনে তিনি আর প্রার্থী হননি। তখন সেই সময়কার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হাজী মোঃআলী মিয়া প্রার্থী হন এবং উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আলী মিয়া সাহেব উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের পদ শূন্য হয়, তখন দূরদর্শী আলী মিয়া সাহেব সুকৌশলে লামা সর্বস্থরের মানুষকে পাঠিয়ে জোর করে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে জনাব আবদুল মালেক চৌধুরীকে অন্তবর্তীকালীন সময়ের জন্য চেয়ারম্যান মনোনিত করেন।

পরবর্তী ১ম মেয়াদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় এবং ২য় মেয়াদে প্রতিদ্বন্দ্বীতার মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে সর্বোমোট তিন মেয়াদে লামা সদরের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ন্যায় বিচারে, এলাকার উন্নয়নে, দানে, সহযোগীতায়, ভালবাসায় তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন জনপ্রিয়তার এক অনন্য উচ্চতায়।

চতুর্থবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ১৯৯২ সালে তিনি মাত্র এক (১) ভোটে হেরে গিয়েছিলেন তার নিজের শিষ্য ও ভাগিনা প্রতীম মরহুম আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইসমাইল(সাবেক ইউ পি,পৌরসভা ও উপজেলা চেয়ারম্যান) এর কাছে।
কিন্তু এতে করে মামা ভাগিনার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ঘাটতি হয়নি বরং আজীবন পরস্পর পরস্পরকে ভালবেসেছেন।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি কখনোই আক্রমনাত্মক ও প্রতিহিংসামূলক দৃষ্টিভঙ্গী ধারন করেননি তিনি। নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী হলেও তিনি ছিলেন দল মতের উর্ধ্বে সর্বজনীন নেতা।
তাইতো অর্জন করেছিলেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা।১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এম পি প্রার্থী হয়ে লামা উপজেলায় পেয়েছিলেন বিশাল ব্যবধানে সর্বোচ্চ ভোট।

এই অঞ্চলের মানুষের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন মালেক সাহেব হিসেবে। সবার শ্রদ্ধার, আস্থার এবং ভালবাসার মালেক সাহেব। দিন,রাত এমন কি মধ্যরাত,শেষরাত যেকোন সময় মালেক সাহেবের ঘরের দরজা খোলা ছিল সহযোগিতা ও সাহায্য প্রার্থীদের জন্য। নিজেকে সর্বোচ্চ উজাড় করে দিতেন মানুষ, সমাজ ও দেশের প্রয়োজনে।
মানুষকে আপ্যায়ন করা ছিল তার নেশা।

১৯৭১ সালে দেশ মাতৃকার প্রয়োজনে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহন করলেও কেন জানি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ গ্রহনের নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায় তিনি কখনোই সামিল হননি এবং এটা নিয়ে তার কোন আগ্রহ কখনো লক্ষ্য করা যায়নি।

অসংখ্য শিক্ষা, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা,দাতা ও পৃষ্ঠপোষক তিনি।
সরকারী মাতামুহুরি কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও দাতা। লামা আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় ও লামা প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠায় পালন করেছেন অগ্রনী ভূমিকা।
লামা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। লামা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নে ও ছিল তাহার নিরলস প্রচেষ্টা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don`t copy text!