আহসান হাবীব স্টাফ রিপোর্টারঃ-



এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে ১৯৭১ সালে দেশমাতৃকার মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজের জীবন বাজি রেখে ও বুকের তাজা রক্ত দিয়ে এ দেশকে স্বাধীন করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধারা নিঃসন্দেহে এ দেশের বীর সন্তান। সব বাধাবিপত্তির পথ পাড়ি দিয়ে যাঁরা অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন, অসম্ভবকে সম্ভব করার কল্পনা করতে পারেন এবং শেষ পর্যন্ত সেই কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেন, কেবল তাঁরাই পারেন বিপ্লব আনতে, বিপ্লব সংঘটিত করতে।

১৯৭১ সালে এ বিষয়টিই আরেকবার প্রমাণ করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা নামক এ দেশের বীরসন্তানেরা। ১৯৭১ সালে তাঁরা সমরাস্ত্রে সজ্জিত প্রশিক্ষিত পাক হানাদার বাহিনীর হিংস্রতার সামনে শুধু দেশপ্রেমকে পুঁজি করে যুদ্ধে নেমেছিলেন। সেই বীর সংশপ্তকেরা সেদিন সবকিছু ত্যাগ করেছিলেন শুধু দেশমাতৃকার জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সফি উল্যা। তিনি একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে কোমরে এবং পায়ে শত্রুর আঘাতে আহত হন তিনি। সেই ক্ষতচিহ্নই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে তার। তিনি এখনো কোমরে এবং দুই পায়ে আঘাতের চিহ্ন নিয়ে তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে বসবাস করছেন।

নোয়াখালী সুবর্ণচর উপজেলার ৫নং চরজুবিলী ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডে উপজেলা পরিষদ সংলগ্নে তার বাড়ি। ১৯৭১ সাল। তবে স্বাভাবিকের চেয়ে বয়সটা ছিল একটু বেশি। ২০ বা ২২ বছর হবে। টগবগে যুবক বীর মুক্তিযোদ্ধা সফি উল্যা।

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সফি উল্যা বলেন, কর্ণফুলি পেপার মিলে মাষ্টাররুলে কেমিক্যাল প্লান্টে চাকুরী করতাম, ৭ মার্চের ভাষণে বুকভরা চেতনা ও দেশকে স্বাধীন করার প্রত্যয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার জন্য রেসকোর্স ময়দানে হাজির হই। ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে যখন শুনলাম বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে, তখনই রাঙ্গামাটি জেলার ডিসির নেতৃত্বে ও স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের আহবানে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি।

২৫ মার্চের পর থমথমে অবস্থা। গ্রামে গ্রামে চাপা আতঙ্ক। এপ্রিলের প্রথম দিকে চন্দ্র ঘোনা ফাঁড়ি থানা থেকে আমাদের ৫০ জনকে অস্ত্র হাতে তুলে দেন রাঙ্গামাটির ডিসি। অস্ত্র হাতে পাওয়ার পর সিকিউরিটি গার্ড শেখ জাকিরের কমান্ডে সেকশন কমান্ডারের ১২ সৈনিকের দ্বায়িত্ব দেন আমাকে।

জয়েজ আহমদ, মুকবুল আহমদ, আমান উল্যা, জয়নালসহ ৫০ জন সৈনিককে সাথে নিয়ে চট্টগ্রাম মদিনা ঘাট পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জাঁপিয়ে পড়ি, ওখান থেকে ক্যাপটিন করিমের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম নিউমার্কেট, মধ্যম মাদ্রাসা এলাকায় যুদ্ধ করি, ১৩ এপ্রিল মদিনা ঘাটে শত্রুদের এ্যাটাকে পড়ি, ওখান থেকে অস্ত্র হাতে নিয়ে কর্ণফুলি নদী সাঁতরিয়ে ওপারে চলে যাই। আওয়ামীলীগ নেতা হাসান মাহমুদের নির্দেশে পটিয়া চরণদ্বীপ পাঠান আমাদের কয়েকজনকে, সেখানে কদুরখিল, চরণদ্বীপ,পটিয়ায় যুদ্ধে করি। পটিয়ায় পাকিস্তানি পাক হানাদার বাহিনীর গ্রেনেডের আঘাতে আমি আহত হই, এসময় আমার দুই পা,কোমর পুরুষাঙ্গে প্রচন্ড আঘাত পাই, চিকিৎসার জন্য আমাকে কদুরখিল নিয়ে যায় স্থানীয় কিছু লোকজন, ওখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর আমাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়।

সামান্য একটু সুস্থ হওয়ার পর ভারতের দেমাগগিরিতে আমাদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন,পর্যায়ক্রমে শেখান থ্রি নট থ্রি, মার্ক ফোর রাইফেল, এস এল আর রাইফেল, এল এম জি, স্টেনগান আর হ্যান্ড গ্রেনেড ও ফিফটি টু গান গ্রেনেড চালানোর নিয়ম-কানুন। এক সপ্তাহ প্রশিক্ষণ শেষে ভারতের মাইনকার চর দিয়ে রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, চিলমারি, অলিপুর থানাসহ বিভিন্ন এলাকায় আবারো যুদ্ধে জাঁপিয়ে পড়ি, অলিপুর থানা হানাদারমুক্ত করতে আমরা আক্রমণ করি। থানা এ্যাটাক করার সময় ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়ে যায়।

তিনি আরো বলেন, আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে প্রাণে বেঁচে রয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সবকিছু চোখে ভাসে। কতো কষ্ট, দুর্দশা ছিল মানুষের। কতো ত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। যুদ্ধাহত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭১ সালে দেশমাতৃকার টানে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে আহত হয়ে বর্তমানে বানবেতর জীবন যাপন করছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জন করেও জীবন যুদ্ধে পরাজিত যেন তিনি, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিদা পেলেও স্থানীয় সুযোগ সুবিদা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন তিনি। মাত্র ২৪ শতাংশ জমির ওপর ছোট্ট একটি জরাজীর্ণ ঘর থাকলেও চলাচলের নিজস্ব রাস্তা নেই তার, সরকারিভাবে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ঘর বরাদ্দ থাকলেও অদৃশ্য কারণে ঘর পাননি তিনি।

একান্ত সাক্ষাৎকারে যুদ্ধাহত এ বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ছয় ছেলে মেয়ে ও কয়েকজন নাতি নাতনি নিয়ে জরাজীর্ণ ঘরে বসবাস করে আসছি, আমার চলাচলের জন্য নিজস্ব পথ নেই, ছোট ছেলে শাহাদাত ইসলাম বেকার, কোন প্রকার কাজ না পাওয়ায় বাড়িতে বসে বেকারত্ব জীবন যাপন করছে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আকুল আবেদন, আপনার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করছি, যুদ্ধে শত্রুর আঘাতে আহত হয়েছি, আমার বর্তমান অবস্থা খুবই খারাপ যাচ্ছে, একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনার কাছে আমার তিনটি দাবী, (১) আমার বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য চলাচলের ২-৩ শতাংশ জমির খুবই প্রয়োজন। (২) আমার ছেলে শাহাদাত ইসলামের একটি চাকুরী খুবই প্রয়োজন। (৩) আমার বসবাসের জন্য একটি পাকা অথবা সেমি পাকা ঘরের খুবই প্রয়োজন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি দয়া করে এ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সামান্য তিনটি দাবী পূরণ করে দিলে নামাজ পড়ে আপনার জন্য দোয়া করবো এবং বাকি জীবন আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don`t copy text!