রাজধানীর মেগা প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি কতদূর?

আমূল বদলে যাবে ঢাকার যাতায়াত ব্যবস্থা, অপেক্ষা উদ্বোধনের

 

মহামারীর কারণে দুই বছরের বেশি সময় জনজীবনে স্থবিরতায় কাটলেও বর্তমান সরকারের নেওয়া প্রকল্পগুলোর কাজের গতি ছিল স্বাভাবিক। বিশেষ করে মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ এগিয়েছে দ্রুত গতিতে। ফলে প্রকল্পগুলো এখন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। এর মধ্যে দুটি মেগা প্রকল্প হলো মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।

 

মেট্রোরেল:

মহানগরী ঢাকায় যানজট নিত্য সমস্যা। রাজধানীর মানুষকে সহজে যাতায়াত সুবিধা দিতে আওয়ামী লীগ সরকারের একটি মেগা প্রকল্প হলো মেট্রোরেল। আধুনিক নগরে যানজট নিরসনের পাশাপাশি কম সময়ে বেশী যাত্রী পরিবহণের কারণে উন্নত বিশ্বেও মেট্রোরেল সমাদৃত।

 

২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় ছয়টি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এই ছয়টির আওতায় মোট ১২৮ দশমিক ৭৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে।

 

তার মধ্যে উড়াল ৬৭ দশমিক ৫৬৯ কিলোমিটার এবং পাতাল ৬১ দশমিক ১৭২ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে। এতে মোট ১০৪টি স্টেশন থাকবে। যার মধ্যে উড়াল স্টেশন হবে ৫১টি এবং পাতাল হবে ৫৩টি।

 

যে ছয়টি মেট্রোরেল লাইন:

 

এমআরটি লাইন-৬, এমআরটি লাইন-১, এমআরটি লাইন-৫: নর্দান রুট, এমআরটি লাইন-৫: সাউদার্ন রুট, এমআরটি লাইন-২ এবং এমআরটি লাইন-৪।

 

ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) নামে একটি সংস্থা গঠন করেছে সরকার।

 

লাইনগুলোর মধ্যে এমআরটি লাইন-৬ এর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আর বাকিগুলো এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এমআরটি লাইন-৬ উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত হচ্ছে।

 

এমআরটি লাইন-১ হবে দেশের প্রথম পাতাল মেট্রোরেল। ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন-১ দুটি অংশে বিভক্ত। অংশ দুটি হলো- বিমানবন্দর রুট (বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর) এবং পূর্বাচল রুট (নতুন বাজার থেকে পিতলগঞ্জ ডিপো পর্যন্ত)।

 

এমআরটি লাইন-৫: নর্দান রুটটি ২০২৮ সালের মধ্যে হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত পাতাল ও উড়াল সমন্বয়ে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে। এমআরটি লাইন-৫: সাউদার্ন রুটটি ২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত ১৭ দশমিক ৪০ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে। তার মধ্যে পাতাল ১২ দশমিক ৮০ কিলোমিটার এবং উড়াল ৪ দশমিক ৬০ কিলোমিটার।

 

এমআরটি লাইন-২: ২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে চট্টগ্রাম রোড পর্যন্ত উড়াল ও পাতাল সমন্বয়ে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ জি২জি ভিত্তিতে পিপিপি পদ্ধতিতে এমআরটি লাইন-২ নির্মাণ করা হবে। এরই মধ্যে জাপান ও বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে

 

এমআরটি লাইন-৪ এর নির্মাণকাজও শেষ করা হবে ২০৩০ সালের মধ্যে। পিপিপি পদ্ধতিতে কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে ট্রাকের পাশ দিয়ে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল মেট্রোরেল হিসেবে এমআরটি লাই-৪ নির্মাণের উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন।

 

জানা গেছে, চলতি বছরের ডিসেম্বরেই উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত কাজ চলছে পুরোদমে। এটাও খুব দ্রুত শেষ করা হবে।

 

২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এই মেট্রোরেল করা হচ্ছে। ৩১ মে পর্যন্ত এর সার্বিক অগ্রগতি ৮০.১০ শতাংশ। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের কাজের অগ্রগতি ৯২.৪৯ শতাংশ।

 

আর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের কাজের অগ্রগতি ৭৯.৪৭ শতাংশ। ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম এবং রেল কোচ ও ডিগু ইকুপমেন্ট সংগ্রহ কাজের সমইন্বত অগ্রগতি ৮১.১৫ শতাংশ।

 

এছাড়া এমআরটি-৬ এর অধীনে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১.১৬ কিলোমিটার বর্ধিত করার কাজ ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

 

২০২০ সালের প্রথম দিনে ঢাকার দিয়াবাড়ীতে মেট্রোরেলের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ও রেল ট্র্যাক বসানোর কাজের সূচনা করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

 

প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মোট ১৬টি স্টেশন হবে এবং মেট্রোরেল ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।

 

সরেজমিনে দেখা যায়, মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত নয়টি স্টেশনের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। রুফ শেডের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখন স্টেশনের ভিতরের সিঁড়ির কাজ চলছে। এছাড়া প্রবেশ এবং বাহিরের গেটের পাশাপাশি সব কাজই চলছে দ্রুতগতিতে।

 

ইতিমধ্যে এই লাইনে রেলের ট্রায়ালও হয়েছে। এছাড়া রেলের নিচ দিয়ে দীর্ঘদিন নির্মাণ কাজের জন্য রাস্তা অনেকটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো প্রায় জায়গায় খুলে দেওয়া হয়েছে। মিরপুর ১৪ এবং ১০ এলাকায় কিছু জায়গায় সরঞ্জাম থাকলেও বেশিরভাগ জায়গাতেই নেই।

 

কাজীপাড়া শেওড়াপাড়া এলাকায় নির্মাণকাজের জন্য রাস্তা অনেকটা দখল করা ছিল। ব্যারিকেডগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো পিচ ঢালাই হয়নি। ফলে ওই এলাকায় ধুলাবালিতে একটু খারাপ অবস্থা হয়ে আছে। এছাড়া রাস্তাও খনাখন্দে ভরে আছে।

 

এদিকে বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্র এলাকায় ব্যারিকেড সরিয়ে রাস্তায় পিচ ঢালায় করে দেওয়া হয়েছে। সড়ক বিভাজনের মধ্যে লাগানো হচ্ছে ফুল গাছ। ফার্মগেট, কাওরানবাজার, বাংলা মোটর, শাহবাগ এলাকার রাস্তাঘাটে পিচ ঢালাইয়ের কাজ চলছে। ব্যারিকেড সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে বাইতুল মোকারম, প্রেসক্লাব এলাকায় এখনো বেরিকেড দেওয়া আছে।

 

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে:

 

এই বছরের ডিসেম্বরেই বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও রেলগেট পর্যন্ত অংশ চালু করার লক্ষ্যে দ্রুত গতিতে কাজ চলছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ। এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণে ইতালি-থাই ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন লিমিটেড ১ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে চায়না রেলওয়ে কন্সট্রাকসন করপোশনের সঙ্গে।

 

বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। ২৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ৩১টি র্যা ম্পসহ মোট দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার।

 

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) আওতায় এ মেঘা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে আট হাজার ৯৪০ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে দুই হাজার ৪১৩ কো ৮৪ লাখ টাকা। বাকি টাকা দিচ্ছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান।

 

উড়ালসড়কটি ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট হারে টোল দিতে হবে যানবাহনগুলোকে। ঠিকাদারদের সঙ্গে সরকারের চুক্তি ২৫ বছরের। এর মধ্যে সাড়ে তিন বছর নির্মাণকাল। বাকি সাড়ে ২১ বছর টোল আদায় করবে অংশীদার প্রতিষ্ঠান।

 

সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে বলা আছে একনাগাড়ে ১৫ দিন উড়ালসেতুর ওপর দিয়ে সাড়ে ১৩ হাজার যানবাহন না চললে চুক্তির অতিরিক্ত আরও ১৫ দিন টোল আদায়ের সুযোগ পাবে অংশীদাররা।

 

তিন ধাপে এর কাজ সম্পন্ন হবে। প্রথম ধাপে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বনানী রেল স্টেশন পর্যন্ত অংশের দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। দ্বিতীয় ধাপে বনানী রেলস্টেশন থেকে মগবাজার রেলক্রসিং পর্যন্ত ৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার। তৃতীয় ধাপে মগবাজার রেলক্রসিং থেকে চিটাগাং রোডের কুতুবখালী পর্যন্ত ৬ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার পর্যন্ত নির্মাণ করা হবে।

 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এয়ারপোর্ট থেকে বনানী পর্যন্ত অংশের কাজ অনেকটাই এগিয়েছে। বেশীরভাগ স্থানেই টি গার্ড এবং স্ল্যাব বসানোর কাজ শেষ। সংশ্লিষ্ঠরা জানান, এ অংশে ৫৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এখন যে কাজ বাকি আছে ডিসেম্বরের আগে শেষ করা সম্ভব।

 

এদিকে প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপটি বনানী রেলস্টেশন থেকে মগবাজার রেলক্রসিং পর্যন্ত ৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার। কিন্তু এ বছরের ডিসেম্বরে তেজগাঁও রেলগেট পর্যন্ত অংশ খুলে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ চলছে। বনানী থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত পিলারগুলোর ওপর টি-গার্ড বসানোর কাজ চলছে। টি-গার্ড বসানোর কাজ শেষ হলেই বসবে স্ল্যাব। এরপর পিচ ঢালায় করে কাজ সম্পন্ন করা হবে।

 

প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ডিসেম্বরের আগেই এ কাজ শেষ করতে দিন-রাত কাজ চলছে। এখনো যে সময় আছে এর আগেই কাজ শেষ হবে বলে আশাবাদী তারা।

 

তৃতীয় ধাপের মগবাজার-চিটাগাং রোডের কুতুবখালী পর্যন্ত অংশের প্রস্তুতিমূলক কাজ চলছে। খিলগাঁও এলাকায় চলছে পিলারের ওপর টি-গার্ড বসানোর কাজ। এ অংশের অনেক কাজ এখনো বাকি। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্ধারিত সময়ের আগে কাজ শেষ করতে তারা বদ্ধ পরিকর।

 

জানা গেছে, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েকে বিমানবন্দর এলাকায় সংযুক্ত করা হবে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে।এতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-জামালপুর, ঢাকা-মানিকগঞ্জ-তেঁতুলিয়া, ঢাকা-মাওয়া-বরিশাল মহাসড়কের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করবে এ প্রকল্প।

 

এছাড়া ঢাকা ও আশুলিয়া-সাভার এলাকার যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখবে উড়ালসড়ক। এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হয়ে তৈরি করবে আন্তঃদেশীয় সড়ক যোগাযোগের সুযোগ।

 

এক্সপ্রেসওয়ে দুটি চালু হলে দেশের উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের বাসিন্দারা ঢাকার ভেতরের যানজট এড়িয়ে শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে পারবেন।

 

উল্লেখ্য, ঢাকার উত্তর-দক্ষিণে সংযোগকারী ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটারের এই উড়াল সড়ক প্রকল্পটি ২০১১ সালে হাতে নেয় সরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don`t copy text!