মাসুদ আলী পুলক রাজশাহী ব্যুরো:-
‘মাদক কারবারির’ স্ত্রীর কাছ থেকে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগে ওসি মাহবুবুল আলমকে চারঘাট থানা থেকে প্রত্যাহার করেছেন রাজশাহীর পুলিশ সুপার (এসপি) সাইফুর রহমান। তাকে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে বলে জানান।
জানা যায়, ‘মাদক কারবারির’ স্ত্রী সাহারা বেগম (২৮) ওসি মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন। সঙ্গে ওসির কথপোকথনের একটি মোবাইল ফোন রেকর্ডও রাজশাহীর এসপির কাছে জমা দেন।
রোববার (১৭ সেপ্টেম্বর) সকালে জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও বিশেষ শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) রফিকুল আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, রাতে ওসি মাহবুবুল আলমকে চারঘাট থানা থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। এখন তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত হবে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে ওসি তার কোয়ার্টারের শয়নকক্ষে ডেকে নিয়ে সাহারা বেগমের কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করেন। এ টাকা দিলে তাকে অবাধে মাদক ব্যবসা করতে দেবেন বলে জানান ওসি। এ নিয়ে শনিবার রাজশাহীর এসপির কাছে লিখিত অভিযোগ দেন ওই নারী। অভিযোগের সঙ্গে রেকর্ড করে রাখা ৬ মিনিটি ৫৩ সেকেন্ডের কথোপকথনের অডিও জমা দেওয়া হয়। গৃহবধূ সাহারা বেগমের বাড়ি চারঘাট থানার চামটা গ্রামে। তার স্বামী আব্দুল আলিম কালু মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বেশ কিছুদিন ধরে কারাগারে। কালু গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শলুয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সদস্য পদে নির্বাচন করেন। এর জের ধরে মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন সাহারা বেগম।
তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ ও র‌্যাবের সোর্স হিসাবে কাজ করেন। চারঘাট এলাকায় তার সোর্সের মাধ্যমে অনেক মাদক র‌্যাব-পুলিশ জব্দ করেছে। গত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে তিনি সদস্য পদে নির্বাচন করেন। এরপর থেকে এলাকার মুক্তা, শুভ ও সাব্বিরের সঙ্গে আমার স্বামীর বিরোধ বাঁধে। এর জের ধরে আমার স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করায় তারা।’
তিনি বলেন, ‘চারঘাটের চামটা গ্রামের মুক্তা, শিবপুর গ্রামের সাব্বির ও শলুয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ শুভ আমার কাছে ১ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা না দিলে মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেয়। সেই অভিযোগ করতে থানায় গেলে ওসি ৭ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করে আমাকে মাদকের ব্যবসা করতে বলেন। তাতে আমি রাজি না হলে মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেন।’
লিখিত অভিযোগে সাহারা বলেছেন, গত ১৩ সেপ্টেম্বর থানায় চাঁদাবাজির অভিযোগ করতে গেলে গৃহবধূ সাহারা বেগম ও তার ছেলে রাব্বিকে নিজের শয়নকক্ষে ডেকে নেন ওসি মাহবুবুল আলম। প্রথমে ওসি তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে নেন। এরপর কথা বলতে শুরু করেন।
অডিও রেকর্ডে ওসি মাহবুবুল আলমকে বলতে শোনা যায়, ‘নির্বাচন করতে মন্ত্রী আমাকে গাইবান্ধা থেকে এখানে নিয়ে এসেছেন। আমি তার কথা ছাড়া কারও কথা শুনি না।’ চারঘাট এলাকায় গিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের ধরে মামলা দেওয়ার কারণে জেলা ডিবি পুলিশের সমালোচনা করেন তিনি। এরপর বলেন, ‘দুই লাখ টাকা দেন, কালকেই ডিবির ওসিকে (পরিদর্শক আতিক রেজা সরকার) বদলি করে দেবো। এবার আপনার পরিবারের কাউকে ধরলে ১০ লাখ টাকার কমে ছাড়াতে পারবো না।’
এরপর ওসি বলেন, ‘এখনো তোমার গায়ে আঁচড় দেইনি। বহুত ফাঁকি দিয়েছো। কালকে ৫ লাখ টাকা নিয়ে আসবা। এখন সেরকম সময় নয় যে কেউ পয়সা খায় না। সবাই পয়সা খাচ্ছে। এমন কেউ বাদ নেই যে পয়সা খাচ্ছে না। পুরো জেলা পয়সা খাচ্ছে। এখানে আমার থানা চালাতে মাসিক অনেক টাকা লাগছে। আমি স্যারকে কথা দিয়ে এসেছি। স্যারকে বলেছি, এখানে মাদক ছাড়া কিছু নেই।’
ওসি আরও বলেন, ‘মুক্তা (চারঘাটের মাদক সম্রাট নামে পরিচিত) অ্যাকশন নিতে পারবে না, শুভ (ছাত্রলীগ নেতা ও মাদক কারবারি) অ্যাকশন নিতে পারবে না। তোমরা ৫ লাখ টাকা দিতে পারবা? ধরে ওদের চালান দিয়ে দেবো। থাকি না থাকি ওদের সাইজ করবো। তোমরা বাইরে থেকে ব্যবসা (মাদক ব্যবসা) করবে।’ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক আতিক রেজা সরকারের আবারও সমালোচনা করে ওসিকে বলতে শোনা যায়, ‘নির্বাচনের আগে শুভকে ধরতে পারবো না। কথা সব ভেঙে বলবো না। কথা সব হয়ে গেলো; যদি আতিকের বদলি চাও ২ লাখ টাকা দাও। কালকেই আতিকের বদলি হয়ে যাবে।’
ওসি মাহবুবুল আরও বলেন, ‘৫ লাখ আর ২ লাখ- ৭ লাখ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করো। আতিক বাদ, ওই দুইজনকে (মুক্তা ও শুভ) ট্যাকেল দেওয়ার দায়িত্ব আমার। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে মন্ত্রীকে বলে ওই দুইজনকে ধরে অ্যারেস্ট করে চালান করে দেবো। আমার সব ওপরের লাইন। যে টাকা দিবা এই টাকাই ওপরে কাজ করবে।’
অভিযোগের বিষয়ে শনিবার রাতে যোগাযোগ করা হলে ওসি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমার কাছেও অডিওটা এসেছে। কিন্তু কীভাবে হয়েছে আমি জানি না।’ এরপরই ওসি ফোন কলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে কল দেওয়া হলেও আর ধরেননি। আজ (রোববার) সকালে চারঘাট থানার সরকারি মোবাইল ফোনটি আর ওসি মাহবুবুল আলমের কাছে পাওয়া যায়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don`t copy text!
%d bloggers like this: