নিজেস্ব প্রতিবেদনঃ
বিশ্বজুড়ে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা করলে সর্ব প্রথমেই আসবে করোনাকালীন মহামারী। এই মহামারীর আগের ও পরের পৃথিবী একেবারেই আলাদা। সর্বশেষ স্প্যানিশ ফ্লুর একশ বছরের বেশি সময় পরে আরেকটি মহামারী দেখল বিশ্ববাসী। এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে এই মহামারীর প্রভাব পড়ে নি। অর্থনীতি, চিকিৎসা, শিক্ষা, বিনোদন, খেলাধুলা ইত্যাদি সবকিছুই যেন হঠাৎ থমকে গিয়েছিল। বৃহত্তর ভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় বিশ্বজুড়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হয়েছে এই সময়ে তা নিকট ভবিষ্যতে পূরণ করাও কঠিন হবে।

এই সময়ে সারা পৃথিবীতে ১৬০ টির বেশি দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ১০০ কোটির বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের নব্বই ভাগের বেশিই নিম্ন আয় বা নিম্ন মধ্যবর্তী আয়ের দেশের শিক্ষার্থী। এই হিসাবে বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে কোভিডের আঘাত খুবই মারাত্মক, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষায়। স্কুল বন্ধ থাকাকালীন সময়ে শুধুমাত্র পড়াশোনার ক্ষতি হয়েছে ব্যাপারটি এমন নয়, শিশুর মানসিক বিকাশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সামাজিকতা, নৈতিকতা, শিষ্টাচার ইত্যাদি বিষয়ক শিক্ষা যেগুলো সাধারণত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেওয়া হয় তা থেকেও বঞ্চিত হয়েছে।

অতীতেও বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীবাসী বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, মানুষেরাই সব সমস্যার সমাধান করেছে। প্রযুক্তি নির্ভর বর্তমান সময়ে, বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে ডিজিটাল প্রযুক্তি হয়ে উঠল শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম হাতিয়ার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিক নির্দেশনায়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মহোদয়, মাননীয় সচিব মহোদয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মাননীয় ডিজি মহোদয়ের নির্দেশনায় দেশ জুড়ে প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যবহৃত হতে থাকে ডিজিটাল প্রযুক্তির।

বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে একেবারেই প্রান্তিক শ্রেনীর মানুষ বা বেশির ভাগ জনগণ ডিজিটাল প্রযুক্তির সাথে পরিচিত নয় বা অভ্যস্ত নয় সেখানে প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান খুবই কঠিন একটা ব্যাপার ছিল, চ্যালেঞ্জিংও বটে। প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের সবাই মিলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছে। প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের পাশাপাশি অভিভাবক, প্রতিটি গ্রামের শিক্ষিত মানুষজন, শিক্ষিত যুব সমাজকে সাথে নিয়ে কার্যক্রম শুরু করা হয়। একসাথে শুরু হয় বাংলাদেশের ৬৪ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান। ইউটিউব, ফেসবুকের মাধ্যমে শুরু হয় পাঠদান। এক্ষেত্রে শহর কেন্দ্রীক শিক্ষার্থীরা সুফল পেলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট ভিত্তিক সেবা বা অনলাইন ভিত্তিক পাঠ দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠে। এরপর টেলিভিশনের মাধ্যমে পাঠদান করা হয়। সব শিক্ষার্থীদের বাড়িতে টিভি থাকবে বা নেই এটা খুবই স্বাভাবিক। তাদেরকে পরামর্শ দেওয়া হয় যাদের বাড়িতে টেলিভিশন আছে সেখানে গিয়ে যেন ক্লাস করে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠদানের জন্য বাংলাদেশ বেতারের সহায়তা নেওয়া হয়।

টেলিভিশন বা ইন্টারনেট ভিত্তিক পাঠদানের চেয়ে রেডিওতে আরো বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীদের কাছে পৌছানো সম্ভব হয়। এসময় বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিকল্প উপায় নিয়ে চিন্তা করেছে, কাজ করেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সহ সকল শিক্ষক মিলে বিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। অভিভাবকদের কে নিয়মিত ভাবে পড়াশোনার হিসাবে অবহিত করেছে, পড়াশোনার নির্দেশনাও দিয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে মোবাইল ফোন। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় সব পরিবারেই মোবাইল ফোন আছে। করোনাকালীন সময়ে প্রাথমিক শিক্ষা পাঠদানে মোবাইল ফোনের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বাংলাদেশের সব শিক্ষার্থীদের কাছে হয়তো পৌঁছানো সম্ভব হয়নি, তবে মহামারীর কারণে প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া শিক্ষা ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছে এক আশার আলো, উঁকি দিয়েছে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এমন শিক্ষকও আছেন যিনি হয়তো কখনোই স্মার্টফোন ফোন ব্যবহার করেন নি, তিনিও স্মার্টফোনে ভিডিও ধারন করে তাঁর খুবই গুরুত্বপূর্ণ লেকচার পৌঁছে দিয়েছেন অগণিত শিক্ষার্থীদের মাঝে। যে শিক্ষক মাত্র একটি বিদ্যালয়ের অল্প কিছু শিক্ষার্থীদের পড়াতেন তিনিই ইউটিউবের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশের সব শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন, করতে পারছেন পাঠদান। এসব অকল্পনীয় ব্যাপার গুলো ঘটেছে আমাদের দেশে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট একটি ছেলে বা মেয়ে অনলাইনে ক্লাস করতে পারছে এটি কোন অংশেই ছোট কোন ব্যাপার নয়। করোনার কারনে বন্ধ দুয়ার যেন হাজার দুয়ার খোলার সম্ভাবনা উন্মোচন করে দিল।

সর্বোপরি কোভিড কালীন সময়ে প্রাথমিক শিক্ষায় পৃথিবী জুড়েই শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হয়েছে সেটি অপূরনীয়। তবে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে যতটুকু পূরণ করা সম্ভব তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার, শিক্ষা পরিবারের প্রতিটি মানুষের সর্বাত্মক চেষ্টা যেমন উদাহরণ হয়ে থাকবে তেমনি ভবিষ্যতের লেখাপড়ার অবকাঠামো আরো বেশি প্রযুক্তিগত হতে হবে এবং বাংলাদেশের শিক্ষা পরিবারের সবাই বিশেষ করে শিক্ষক শিক্ষার্থী অভিভাবক সেই প্রযুক্তিগত সিস্টেমে সহজেই খাপ খাওয়াতে পারবে সেটিও প্রমানিত হয়েছে। উন্মোচিত হয়েছে আলোকিত এক নতুন পথের।

আর এই আলোকিত নতুন পথের নির্দেশনা গুলো নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছি আমরা সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারগণ।

মোছাঃ মোস্তাহেদা পারভীন
সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার
ত্রিশাল,ময়মনসিংহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don`t copy text!