
সাব্বির মির্জা স্টাফ রিপোর্টার
দেশব্যাপী চলমান লোডশেডিংয়ের বিরূপ প্রভাব পড়েছে সিরাজগঞ্জের তাঁতশিল্পে। ঘন ঘন লোডশেডিং আর তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন কমে অর্ধেকে নেমেছে। বেতনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় অনেক শ্রমিক এ শিল্প ছাড়তে শুরু করেছেন।
তাঁতমালিকরা বলছেন, উৎপাদন কমেছে, তেলের দাম বেড়েছে। কিন্তু কাপড়ের দাম বাড়েনি। ফলে কম পরিমাণ কাপড় তৈরি হলেও তাতে যে খরচ হচ্ছে, বিক্রির টাকায় তা পোষানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তাঁতশিল্পের বিপর্যয় এড়াতে সরকারের সহায়তা চেয়েছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে সমন্বয় করে পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস তাঁত বোর্ডের।
জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলায় কমবেশি তাঁত কারখানা আছে। সদর, বেলকুচি, এনায়েতপুর, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া ও চৌহালী উপজেলায় পাওয়ারলুম ও হ্যান্ডলুম রয়েছে অন্তত পাঁচ লাখ। এখানে তৈরি হয় আন্তর্জাতিক মানের জামদানি, কাতান, সিল্ক, বেনারসী, লুঙ্গি, থ্রি-পিস, গামছা ও থান কাপড়। এখানকার উৎপাদিত শাড়ি, লুঙ্গি ও গামছার কদর দেশজুড়ে। জেলার অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির অন্যতম এ শিল্পের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত অন্তত ১৫ লাখ মানুষ। এ কারণে জেলার ব্র্যান্ডিংয়ে বলা হচ্ছে তাঁতকুঞ্জ সিরাজগঞ্জ।
বেলকুচি উপজেলার শেরনগর গ্রামের হাজি আশরাফুল ইসলাম বলেন, তার কারখানায় ৪৫টি পাওয়ারলুম চলমান। আগে প্রতি সপ্তাহে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার কাপড় উৎপাদন করতেন। কিন্তু বর্তমানে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানায় এখন প্রতি সপ্তাহে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার কাপড় উৎপাদন হচ্ছে।
উৎপাদন কমার কথা বলেন সোহাগপুর কাপড়হাটের ইজারাদার হাজি বদর উদ্দিন মণ্ডলও। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের আগে সোহাগপুর কাপড়হাটে প্রতি সোম ও মঙ্গলবার ৪০-৫০ কোটি টাকার কাপড় বিক্রি করতেন তাঁতিরা। কিন্তু করোনার পর থেকে ধীরে ধীরে বেচাকেনা কমে গেছে। বিশেষ করে লোডশেডিং ও তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে কাপড়হাটে ২৫-৩০ কোটি টাকার কাপড় বিক্রি হচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতির কারণে কারখানা বন্ধ রাখার কথাও জানিয়েছেন কয়েকজন কারখানার মালিক। তাদেরই একজন বেলকুচির শেরনগর গ্রামের গোলাম সারোয়ার। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় লোডশেডিংয়ের সময় জেনারেটর ব্যবহার করতে হয়। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কাপড়ের দাম না বাড়ায় বাধ্য হয়ে উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে কারখানায়।
কারখানা যেমন বন্ধ হচ্ছে, তেমনি পেশাও বদলাচ্ছেন শ্রমিকরা। বেলকুচি পৌর এলাকার চন্দগাতী বসুন্ধরার তাঁতশ্রমিক আয়নাল হক ১৪ বছর বয়স থেকে এ পেশার সঙ্গে জড়িত। আগে হ্যান্ডলুমে কাপড় তৈরি করতেন। তখন মজুরি কম হলেও দ্রব্যমূল্যের দাম কম থাকায় দিন চলে যেত।
আয়নাল বলেন, এখন বিদ্যুৎচালিত পাওয়ারলুম আসায় পরিশ্রম কম হলেও সুখ নেই। তেলের দাম বৃদ্ধির পর থেকে কাজ নেই বললেই চলে। আগে বিদ্যুৎ গেলে মহাজন জেনারেটর চালিয়ে দিতেন। এখন জেনারেটর চালানো হয় না। অন্যদিকে দিনে পাঁচ-সাতবার বিদ্যুৎ চলে যায়। দিনে ৩০০ টাকারও কাজ করতে পারেন না।
পারিবারিকভাবে তাঁতের কাজ করেন বানিয়াগাতী গ্রামের জয়নাল আবেদিন। তার ঘরে চারটি পাওয়ারলুম আছে। পরিবারের সদস্যরা মিলে চালান। বাইরের কোনো শ্রমিক নেই।
জয়নাল বলেন, জেনারেটর না থাকায় বিদ্যুতের ওপর ভরসা করতে হয়। করোনাকালে তাঁত চালাতে গিয়ে অনেক ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। সেই ঋণ কিছুদিন আগে পরিশোধ করতে পারলেও লোডশেডিংয়ে নতুন বিপর্যয় হয়েছে। বাধ্য হয়ে তাঁত বন্ধ করে অন্য কাজ করার চেষ্টা করছেন। বড় ছেলেকে ঋণ করে একটা অটোভ্যান কিনে দিয়েছেন।
বেলকুচি তাঁত বোর্ডের লিয়াজোঁ অফিসার তন্নী সরকার বলেন, এমন পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে পদক্ষেপ নেয়া হবে। তবে বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে তাঁতশিল্পে উৎপাদন অনেক কমে গেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক হলেই আবার প্রাণ ফিরে পাবে এই শিল্প।
বেলকুচি পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সানোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা যেভাবে বিদ্যুৎ পাই, সেভাবেই বণ্টন করে থাকি। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই। তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদের বলেছেন, আগামী মাস থেকে হয়তো বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক অবস্থায় আসবে।’